Menu

ফরাসি বিপ্লবের কারণগুলি লেখ

ফরাসি বিপ্লবের কারণগুলি লেখ

সূচনা

ফরাসিরা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে যে বিপ্লব ঘটিয়েছিল, তা ইতিহাসে ‘ফরাসি বিপ্লব’ নামে খ্যাত। ফরাসি বিপ্লব ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিপ্লবের মাধ্যমে ফরাসি জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। 

ফরাসি বিপ্লবের কারণ

ঐতিহাসিকদের মতে, ফরাসিদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য ও ক্ষোভের কারণেই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব ঘটেছিল। নিম্নে ফরাসি বিপ্লবের কারণ আলোচিত হলো।

  • সামাজিক কারণ : ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ফরাসি সমাজে বৈষম্য ও শোষণ। ফরাসি সমাজ সামন্ততন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল : প্রথম শ্রেণি (যাজকগণ), দ্বিতীয় শ্রেণি (অভিজাতবর্গ), তৃতীয় শ্রেণি (ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি)।
  1. First Estate : ধর্মযাজক সম্প্রদায় ফ্রান্সের সমাজে প্রথম শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। এঁরা ছিলেন সুবিধাভোগী এবং সংখ্যায় ফরাসি জনগণের ১%-এরও কম। তা সত্ত্বেও এঁদের দখলে ছিল ফ্রান্সের মোট জমির ১০%। অথচ এই জমির জন্য এঁরা রাজাকে কোনো কর দিতেন না। এরা সমস্ত সম্পত্তি ভোগ ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন।
  2. Second Estate : ফরাসি সমাজে অভিজাতরা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। এঁরা ছিলেন ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৫%। অথচ ফ্রান্সের মোট জমির ২০% ছিল এঁদের দখলে। এঁরা জমির জন্য সরকারকে কোনো প্রত্যক্ষ কর দিতেন না। আবার সরকারের উচ্চপদগুলিতে এঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল।
  3. Third Estate : ফরাসি সমাজের ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, সর্বহারা সকলেই ছিলেন তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত। এদের মোট জনসংখ্যা ছিল ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার ৯৭%-এর বেশি। সমাজে এদের বংশকৌলীন্য ছিল না। ফ্রান্সের করের বোঝার বেশির ভাগটাই এদের বহন করতে হত। ফ্রান্সে সবক্ষেত্রে এরা ছিলেন অসাম্যের শিকার। তাই তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত মানুষেরা তাদের প্রতি শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়নের প্রতিবাদে বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
  • অর্থনৈতিক কারণ :
  1. বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা : ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণিভুক্ত ধর্মযাজক ও দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত অভিজাতরা বেশির ভাগ ভূসম্পত্তি ভোগ করলেও তাঁদের কর দিতে হত না। অপরপক্ষে সরকারের মোট রাজস্বের ৯৬% দিতে হত তৃতীয় সম্প্রদায়কে। এই অত্যধিক করের বোঝা তৃতীয় সম্প্রদায়কে বিদ্রোহী করে তুলেছিল।
  2. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে মুদ্রাস্ফীতির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু জনগণের আয় সেই পরিমাণে বাড়েনি। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। 
  3. কর আরোপের চেষ্টা : রাজপরিবারের বিলাসিতা, যুদ্ধে প্রচুর অর্থ ব্যয়, রাজকোশের অর্থশূন্যতা প্রভৃতি কারণে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই অর্থ সংগ্রহ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি দরিদ্র তৃতীয় শ্রেণির ওপর নতুন নতুন কর আরোপ করতে থাকেন, যার ব্যয়ভার বহন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব ছিল। ফলে মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
  • রাজনৈতিক কারণ :
  1. বুরবোঁ রাজাদের স্বৈরাচারী নীতি : ফ্রান্সের বুরবোঁ বংশের রাজারা ছিলেন স্বৈরাচারী। রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে প্রচার করতেন। রাজা চতুর্দশ লুই বলেছিলেন, ‘আমিই রাষ্ট্র’। রাজা ষোড়শ লুই বলেছিলেন, ‘আমার ইচ্ছাই আইন’। রাজারা প্রজাদের মতামত অগ্রাহ্য করে স্বৈরাচারী শাসন চালাতেন। ফলে প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।
  2. দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারব্যবস্থা : ফরাসি রাজতন্ত্রের বিচারব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। বিচারের নামে প্রহসন চলত। আবার রাজা ইচ্ছামতো বিচারের রায় পরিবর্তন করতে পারতেন। এই চূড়ান্ত অব্যবস্থা মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল।
  3. ভ্রান্ত বিদেশনীতি : ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত যুদ্ধ ও সপ্তবর্ষের যুদ্ধে পরাজিত হন। এর ফলে ভারত ও আমেরিকায় ফরাসি উপনিবেশ হাতছাড়া হয়। অন্যদিকে রাজা ষোড়শ লুই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিলে ফ্রান্সের অর্থনীতি শোচনীয় হয়ে পড়ে। এককথায় বিদেশনীতির ব্যর্থতায় ফরাসি রাজতন্ত্রের মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হয়।
  • বিপ্লব : একদিকে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থায় চরম অসাম্য, অপরদিকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ এবং ‘রাজনৈতিক কারাগার’-এ পর্যবসিত ফ্রান্স বিপ্লবের সূতিকাগারে পরিণত হয়েছিল। যা ফরাসি জনগণকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
আরো পড়ুন :  ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব সম্পর্কে লেখ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!